যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে খুনি কেনেথ ইউজিন স্মিথকে নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) বিতর্কিত পদ্ধতিতে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। তবে জাতিসংঘ, ইইউ এবং মৃত্যুদণ্ডবিরোধী কর্মীরা নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়েছে।
কেনেথ ইউজিন স্মিথকে বৃহস্পতিবার রাতে আলাবামার অ্যাটমোরে একটি রাষ্ট্রীয় ‘উইলিয়াম সি. হলম্যান কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি’ কারাগারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সাল থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন স্মিথ। কেনেথ ইউজিন স্মিথ ১৯৮৯ সালে এক ধর্মযাজকের স্ত্রী এলিজাবেথ সেনেটকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। এলিজাবেথ সেনেটকে খুন করার জন্য কেনেথ স্মিথ এবং তাঁর এক সহযোগীকে ভাড়া করেছিলেন সেনেটের স্বামী চার্লস সেনেট। আইনজীবীরা বলেছেন, স্ত্রীর বীমার টাকা পেতে এ ষড়যন্ত্র করেছিলেন চার্লস।
পরে তিনি আত্মহত্যা করেন। এ হত্যার ঘটনায় স্মিথের সহযোগীকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেনেটকে ফায়ারপ্লেসে ব্যবহৃত একটি সরঞ্জামি দিয়ে পিটিয়ে, বুকে এবং ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছিল। বাড়ির এমন অবস্থায় করে রেখে যাওয়া হয়েছিল যেন মনে হয় সেখানে চুরির ঘটনা ঘটেছে।
মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক বিবিসিকে বলেছেন, ‘গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৫৩ মিনিটের দিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’ মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষকারী পাঁচজন সাংবাদিকের একজন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এত দিন যা দেখেছেন তা থেকে এই পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আলাবামার সাংবাদিক লি হেজেপেথ বিবিসির নিউজডে প্রগ্রামে বলেছেন, ‘আমি এর আগে চারটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখেছি এবং কেনেথ স্মিথকে নাইট্রোজেন গ্যাস দেওয়া শুরু হলে তিনি যেভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তা আমি কখনোই কোনো কয়েদিকে ক্ষেত্রে দেখিনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্মিথ বারবার নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁপিয়ে উঠছিলেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে মোট প্রায় ২৫ মিনিট সময় লেগেছিল।
নাইট্রোজেন গ্যাস শরীরে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড তথ্য কেন্দ্রের মতে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি আগে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। আলাবামার কর্মকর্তারা এর আগে আদালতে বলেছিলেন, স্মিথ সেকেন্ডের মধ্যে জ্ঞান হারাবেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যাবেন। তবে স্মিথের একজন উপদেষ্টা রেভারেন্ড জেফ হুড মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর বলেন, ‘আমি মনে করি, যারা পুরো প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা সবাই জানেন দুই বা তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমরা তাঁকে অজ্ঞান হতে দেখিনি।’ হুড আরো বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি তা হলো, বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা। ওই রুমে উপস্থিত কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছিলেন, এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া কতটা ভয়ংকর।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, ‘নাইট্রোজেন গ্যাসের মাধ্যমে শ্বাসরোধ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পদ্ধতিটি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ, নির্যাতন করার সমান।’ তিনি বিষয়টি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এদিকে এক বিবৃতিতে ইইউ কর্মকর্তারা নাইট্রোজেন গ্যাস নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াকে নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক শাস্তি বলে অভিহিত করেছেন।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আলাবামা ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশনের কমিশনার জন হ্যাম বলেছেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, স্মিথ যতক্ষণ পেরেছেন তাঁর শ্বাস আটকে রেখেছিলেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘অস্বাভাবিক নড়াচড়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে দেখা যায় তাঁকে।’ মৃত্যুদণ্ডের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো সবই প্রত্যাশিত ছিল এবং আমরা নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া নিয়ে গবেষণায় যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জেনেছি তাঁর মধ্যে সবই ছিল।’
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জিন-পিয়েরে শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসন মৃত্যুদণ্ড খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করে। একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে স্মিথের শেষ কথা ছিল, ‘আজ রাতে আলাবামা মানবতাকে এক ধাপ পিছিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ভালোবাসা, শান্তি এবং আলো নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে সমর্থন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি।’ তিনি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে ‘আই লাভ ইউ’ সাইনও তৈরি করেছিলেন বলে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
হত্যাকাণ্ডের শিকার সেনেটের ছেলে মাইক সেনেট বলেছেন, ‘স্মিথ তাঁর ঋণ পরিশোধ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আজ এখানে যা ঘটেছে তা তাঁর মাকে ফিরিয়ে আনবে না। তবে আমরা আনন্দিত যে এই দিনটি শেষ হয়েছে।’ একটি বিবৃতিতে স্মিথের আইনি দল বলেছে, তারা এ ঘটনায় অত্যন্ত দুঃখিত। তিনি তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য আপিল করেছিলেন, কিন্তু একজন বিচারক তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করেছেন।’
এর আগেও ২০২২ সালে আলাবামা প্রাণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে স্মিথের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিল। তখন দণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। ২০২৩ সালের মে মাসেও দ্বিতীয় দফায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচেষ্টা চালানোর এ সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন স্মিথ। এরপর অঙ্গরাজ্যটির গভর্নর কে আইভি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া নতুন করে পর্যালোচনা করার ঘোষণা দেন এবং এর কয়েক মাস পর নাইট্রোজেন গ্যাস প্রয়োগ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) আলাবামা স্মিথ শেষ ৪৮ ঘণ্টা কিভাবে কাটিয়েছেন তার বিররণ প্রকাশ করা হয়েছে। স্মিথকে তাঁর পরিবারের সদস্য, দুই বন্ধু, তার একজন উপদেষ্টা ও আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। তিনি দুটি বিস্কুট, ডিম, আঙ্গুরের জেলি, আপেল সস এবং কমলার জুস দিয়ে নাশতা করেন। তাঁর শেষ খাবার ছিল স্টেক এবং ডিম।
সূত্র : বিবিসি