বিদেশে কর্মী প্রেরণে রেকর্ড, শীর্ষে কুমিল্লা

বাংলাদেশ থেকে গত তিন বছর রেকর্ডসংখ্যক কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এই তিন বছরই কর্মসংস্থানে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা জেলা। অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অর্থনৈতিক ও যোগাযোগব্যবস্থায় এগিয়ে থাকা অঞ্চলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি বেশি। এসব অঞ্চল থেকে শ্রমিক অভিবাসনের হারও তাই বেশি। 

এ ছাড়া যেসব জেলার লোকজন বিদেশে রয়েছেন, তাঁদের সূত্রেও অন্যরা যাচ্ছেন। রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব অঞ্চলের কর্মীদের মধ্যে বিদেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহ বেশি, সেসব অঞ্চল থেকে কর্মী যাওয়ার হারও বেশি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে ২০২১ সালে ছয় লাখ, ২০২২ সালে ১১ লাখ এবং ২০২৩ সালে ১৩ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন।

 

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে কুমিল্লা জেলা থেকে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৪৫৩ জন কর্মী বিদেশে কাজ করতে গেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৬৮ হাজার ৫৮৬ জন, ২০২২ সালে এক লাখ পাঁচ হাজার ৯৯৭ জন এবং ২০২৩ সালে এক লাখ আট হাজার ৮৭০ জন কর্মী গেছেন।

 

বিএমইটির তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কুমিল্লা জেলার পর এই তিন বছরের দুই বছরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই জেলা থেকে ২০২১ সালে ৪৫ হাজার ২৪৩ জন এবং ২০২৩ সালে ৬৪ হাজার ৮০৭ জন কর্মী গেছেন। তবে ২০২২ সালে কুমিল্লার পর চট্টগ্রাম জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি—৬৯ হাজার ৪৪৮ জন কর্মী গেছেন। 
২০২১ সালে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে চাঁদপুর। ওই জেলা থেকে ২৭ হাজার ১০৭ জন কর্মী গেছেন। ২০২২ সালে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের পর তৃতীয় স্থানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওই জেলা থেকে ৬২ হাজার ৬৯৮ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ২০২৩ সালে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরে রয়েছে চট্টগ্রাম।

এই জেলা থেকে ৬৪ হাজার ২০২ জন কর্মী গেছেন।

বিএমইটির তথ্য মতে, রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে সবচেয়ে কম কর্মী বিদেশে গেছেন। রাঙামাটি থেকে ২০২১ সালে ৪১৮ জন, ২০২২ সালে ৯৮৭ জন এবং ২০২৩ সালে ৯৩০ জন কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। বান্দরবান থেকে ২০২১ সালে ২৮৯ জন, ২০২২ সালে ৯৭২ জন এবং ২০২৩ সালে এক হাজার ১১ জন কর্মী গেছেন।কুমিল্লা কেন প্রথম

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে কুমিল্লার মোট শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশ ছিল কৃষিমজুর। কৃষিজমির উৎপাদনই ছিল তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি। কিন্তু উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না। ক্ষুদ্রায়তন কিছু কুটির শিল্প গড়ে উঠলেও বৃহদায়তন ও ভারী শিল্প তখনো গড়ে ওঠেনি। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তাই বিকল্প পেশা খুঁজতে থাকে জেলার মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকে তারা। আশির দশকে তা বেড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা কুমিল্লা।

 

জেলা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৮ বছর ধরে জনশক্তি রপ্তানিতে এগিয়ে কুমিল্লা জেলা। প্রতিবছর কাজ নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া মোট জনশক্তির অন্তত ১০ শতাংশ এই জেলার বাসিন্দা।

 

কুমিল্লার প্রবাসী কর্মীদের ভাবনা

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন দীর্ঘদিন সৌদি আরবপ্রবাসী ছিলেন। জাকির হোসেনের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রবাসে গেছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।

 

কুমিল্লার মানুষ কেন এত বেশি প্রবাসে ছুটছেন, জানতে চাইলে জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রথমেই আমার জন্মস্থান মনোহরগঞ্জের বাকরা গ্রামের কথা বলতে চাই। গ্রামের মধ্যে শতাধিক পাকা বাড়ি রয়েছে। দিন দিন তা বাড়ছে। এসব গড়ে উঠেছে প্রবাসীদের আয়ের টাকায়। আমরা যারা প্রথমে বিদেশে গেছি, তাদের উন্নতি দেখে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে যুবকরা প্রবাসে গেছে। এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের গ্রামের মতো উৎসাহিত হয়ে জেলার প্রতিটি এলাকা থেকে তরুণরা প্রবাসে যাচ্ছে।’

 

একই কথা বলেন জেলার লালমাই উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়নের ভাবকপাড়া গ্রামের যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আবদুল্লাহ আল মামুন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ২০০৯ সালে লন্ডন এসেছি। বর্তমানে এখানে আমার চারটি রেস্টুরেন্ট, একটি মার্কেট ও একটি ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। প্রবাসী আয়ে দেশে প্রায় পাঁচ একর জমি কিনেছি। আমার সমৃৃদ্ধি দেখে অনেকে পরে লন্ডনে এসেছেন। তাঁরাও ভালো আছেন।’

 

একই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের দোশারীচোঁ গ্রামের বাসিন্দা সৌদি আরবপ্রবাসী মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘কুমিল্লার মানুষজন একে অন্যের প্রতি আন্তরিক। বিদেশে কুমিল্লার পরিচয় পেলে একে অন্যকে সহযোগিতা করে। এই কারণে মানুষজন বেশি বিদেশে আসছে।’

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক কুমিল্লার সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, ‘পারিবারিকভাবে সুযোগ পেলেই কুমিল্লার তরুণরা বিদেশে পাড়ি জমায়। কুমিল্লায় এখন শ্রমিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ তাদের বেশির ভাগই এখন প্রবাসে। তারা এখন উন্নত জীবন গড়ার চেষ্টা করছে।’

 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের সভাপতি আবুল বাশার বলেন, ‘রাঙামাটি ও বান্দরবানে কর্মী কম যাওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা অভিবাসন ব্যয় সেভাবে জোগাড় করতে পারে না। এ জন্য এসব অঞ্চলে কর্মীদের মধ্যে প্রবাসে যাওয়ার উৎসাহ তেমন নেই। এ ছাড়া এসব অঞ্চলে আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সি কম। এতে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার মতো কেউ নেই। কুমিল্লা, আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মীর আর্থিক সংগতি যেমন রয়েছে, তেমনি বিদেশে গিয়ে বেশি টাকা আনার উৎসাহও বেশি। এসব এলাকায় রিক্রুটিং এজেন্সির তত্পরতাও বেশি।’

 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি আব্দুর রহমান)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *