দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বেশ সতর্ক অবস্থানে নতুনভাবে দায়িত্ব নিয়েছে বর্তমান সরকার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংকট উত্তরণের কৌশলকে প্রাধান্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মেয়াদের মুদ্রানীতি আগামীকাল বুধবার ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের মুদ্রানীতি ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
গতকাল সোমবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার কথা ছিল; পরে তা দুই দিন পেছানো হয়েছে।
গত রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় ছয় মাস মেয়াদি আগামী জুন পর্যন্ত মুদ্রানীতির খসড়া অনুমোদন হয়েছে।
জানুয়ারি-জুন মেয়াদের এই মুদ্রানীতিতে অর্থনৈতিক সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধান চারটি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, বিশেষভাবে ডলার সংকট মোকাবেলায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংকগুলোর তারল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ। মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া পর্ষদ সভায় আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিলের অর্থ সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের বিষয়েও সিদ্ধান্ত এসেছে।
এতে বাজারে ডলারের দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
সূত্র জানায়, বাজারে ডলারের সংকট কাটাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হবে। এ জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে আরো বাজারভিত্তিক করা হবে। ফলে বাজারে ডলারের দাম আরো বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নির্ধারণ করা ডলার কেনার দাম সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা এবং বিক্রি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। কিন্তু এই দামে বাজারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে গড়ে ১২২ থেকে ১২৬ টাকা করে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। এদিকে আইএমএফ থেকেও ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার চাপ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দামে নিয়ন্ত্রণ আরো শিথিল করতে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ডলারের দাম আরো কিছুটা বাড়লে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন এবং রপ্তানি আয়ও কিছুটা বাড়বে। এতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বুধবার বিকেল ৩টায় নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা থাকবে।
সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টানা হবে মুদ্রানীতিতে। এর মাধ্যমে চাহিদা কমানো হবে। ফলে বিলাসবহুল খাতে ব্যয় কমবে। এ খাতে ঋণের প্রবাহও কমানো হবে। একই সঙ্গে উৎপাদন খাতে ব্যয় ও ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হবে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী রয়েছে। ডিসেম্বরে এই হার কিছুটা কমে ৯.৪১ শতাংশে নেমেছে। আগামী জুনের মধ্যে এই হার আরো কমে আসবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া হয়েছিল। গত ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছিল। গত ছয় মাসে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি জানুয়ারিতে ১১.৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমানো সম্ভব হয়নি। গত বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল ছিল দেশের মানুষ। বছর শুরুর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৫৭ শতাংশ। আর সর্বশেষ ডিসেম্বরে এসে তা দাঁড়ায় ৯.৪১ শতাংশে। মাঝে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তবে অর্থনীতিবিদের অনেকে মনে করছেন, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার সরকার প্রকাশিত পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করা। তবে অস্বাভাবিক নিত্যপণ্যের বাজারে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশল চাহিদার দিক থেকে কাজ করবে। মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ সংকুচিত করতে পারবে। এতে মানুষের হাতে টাকা কম থাকে, চাহিদা নিয়ন্ত্রিত হবে। চাহিদার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান মাধ্যম মুদ্রানীতি।
মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক নীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় হার সবগুলোর সমন্ব্বয় সাধন দরকার। সব নীতি সমন্বিতভাবে একটি কাঠামোর মাধ্যমে পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।