সরকারবিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের কর্মসূচির মধ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার, নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নানা কৌশল করছে। সারা দেশে প্রশাসনের উদ্যোগে ভোটারদের উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলছে।
তাই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার বাড়াতে নানা কৌশল নেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টিসহ কিছু দল নির্বাচনে থাকলেও তারা তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে দলের ডামি বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগ বা মিত্র ও শরিক দলের প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকছেন। এবার বিএনপি-জামায়াতের ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), সুপ্রীম পার্টি, কল্যাণ পার্টিসহ কয়েকটি দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এ জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। যদি কেউ ভোটারদের বাধা দেয়, এটা কিন্তু অপরাধ। এতে শাস্তির বিধান রাখা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার আওতায় থাকা প্রায় এক কোটি ভোটারকে কেন্দ্রে আনতে প্রশাসনিক শক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। তাদের কেউ যদি না আসে, ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে নির্বাচনের পর তাদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও প্রচার চলছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে কমপক্ষে ৩০০ জন নিয়োগে ৫৪ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাঁরা ৭ জানুয়ারি সকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলবেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) ৭৫ ওয়ার্ডের কাউন্সিলররাও ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে কর্মীরা তাঁদের বাড়ি বাড়ি যাবেন।
খুলনা-৬ আসনে তৃণমূল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. নাদির উদ্দিন বলেন, ‘ভোট বর্জনের কর্মসূচি দেওয়া হলেও জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া জরুরি। গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তৃণমূলে পাঠানো নির্দেশনা অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিত নিশ্চিত করতে কাজ করছেন নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবারই প্রথম পোলিং এজেন্ট ও দলীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ২৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাজধানীর তেজগাঁওস্থ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
‘রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ ক্যাম্পেইনের’ আওতায় প্রশিক্ষণ নেওয়া দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে ২০০ জন ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশিক্ষণ উপকমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা-৯ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরী জানান, প্রতিটি আসন থেকে নৌকার পাঁচজন পোলিং এজেন্টকে প্রশিক্ষণের জন্য চাওয়া হয়। পোলিং এজেন্টের কাজ কী সবাই জানে। তবে আগের নিয়মের সঙ্গে নতুন কী কী নিয়ম যুক্ত বা পরিবর্তন হয়েছে, সেসব বিষয়ে তাঁদের জানানো হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর নির্দেশনায় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মো. তাকজিল খলিফা কাজল বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় মোট ৪৪টি ভোটকেন্দ্রে ভোট হবে। প্রতিটি কেন্দ্রের দায়িত্বের জন্য একটি করে কমিটি হয়েছে। একটি কমিটিতে ১০১ থেকে ৪০১ জন সদস্য রয়েছেন। ওই সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার আনতে কাজ করবেন।’
ইসি সূত্র জানায়, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করতে আলাদা কর্মসূচি নিয়েছে ইসি। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহিত করতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। তবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার দায়িত্ব প্রার্থীদের।’
এবার নির্বাচনী কার্যক্রমে ভোটারদের পোস্টাল ভোটের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
গতকাল বুধবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তাঁর সহধর্মিণী ড. রেবেকা সুলতানা বঙ্গভবন থেকে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা পাবনা সদর আসনের ভোটার। এ সময় রাষ্ট্রপতি আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আসুন নিজে ভোট দিই, অন্যকে ভোট দিতে উৎসাহিত করি।’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অনুচ্ছেদ-২৭ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপ্রধান পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে চালু হওয়া বিধান অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে যেতে অসমর্থ—এমন চার ধরনের ভোটাররা পোস্টাল ব্যালটে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।
ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনও গণপরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা চলাচল করবে। তবে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও স্টিমার চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিন গণপরিবহন, রেগুলার লাইনের বাস ও প্রাইভেট কারের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।’
জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব বলেন, ‘নির্বাচনে যানবাহন চলাচলে যেসব কঠোরতা ছিল, তা এবার নির্বাচন কমিশনারের মতামত নিয়ে কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে এর মধ্যে সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নেমেছেন।
প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ ভোটারের এই নির্বাচনে ৪২ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। ভোটকেন্দ্রপ্রতি ১৫ থেকে ১৭ জন নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। আনসার-ভিডিপিসহ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা সদস্যরা ভোটের আগের দুই দিন ও পরের দুই দিন মিলিয়ে পাঁচ দিন নিয়োজিত থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিভিন্ন সময়ে ভোটগ্রহণের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হলেও এবার তা নিরবচ্ছিন্ন রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। নির্বাচনের দিন কোনো অপারেটরের ইন্টারনেটের গতি স্লো হবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম।