বই তৈরি করা শিশুরাই বই পড়া থেকে বঞ্চিত

 

বই তৈরির কাজ করছে এক শিশু শ্রমিক।

 

শৈশবে শিশু থাকবে বাবা-মায়ের ভালোবাসায়, বিদ্যালয়ে ও খেলার মাঠে। তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে নিয়োজিত থাকবে অভিভাবক, শিক্ষক ও অন্যরা। কিন্তু সবার ভাগ্যে এসব সুবিধা জোটে না। নতুন বছরে নতুন বই তৈরিতে ব্যস্ত পুরান ঢাকার প্রেসগুলো। এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছে অসংখ্য শিশু। ফলে বই তৈরি করা শিশুরাই বই পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 

প্রেসে কাগজের যোগান দেওয়া, প্রেস চালনা করা, বই বাঁধাই করাসহ বিভিন্ন কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। কারখানাগুলোতে খালি পা আর মুখে মাস্ক ছাড়াই সারাদিন কাজ করে তারা। রাতে ঘুমায় কারখানারই ঘিঞ্জি পরিবেশে। এতে করে বাড়ছে তাদের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব শিশুরা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশব। নষ্ট হচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার পাতলা খান লেন, প্যারীদাস লেন, হেমেন্দ্রদাস লেন, তনুগঞ্জ লেন, শিশিরদাস লেনসহ বাংলাবাজারের আশপাশের বিভিন্ন স্থানের প্রেসগুলোতে চারিদিকে সবাই বই ছাপানো, মেশিন চালানো কিংবা বই বাঁধাইয়ের কাজে ব্যস্ত। কারখানার বিভিন্ন স্থানে স্তুপ করা আছে কাগজ ও বই। এসব কারখানার অধিকাংশ শিশুর বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর। তাদের হাতে-মুখে নাই কোনো মাস্ক। এমনকি কিছু শিশুর গায়ে কাপড় ছিল না। এ সময়ে ছবি ও ভিডিও করতে গেলে শিশুশ্রমিকরা বাঁধা দেয়।

 

তনুগঞ্জ লেনের আদর্শ প্রিন্টার্স লিমিটেডে কাজ করছে টাঙ্গাইল থেকে আসা রিফাত মিয়া। বয়স তেরো। রিফাত বলে, ‘আমি দুইবছর হলো এখানে কাজ করছি। প্রতি মাসে ওভারটাইমসহ ৫ হাজার টাকা পাই। বাড়িতে ২ হাজার টাকা পাঠাই। বাকিটা খাওয়া-দাওয়া ও হাত খরচে ব্যয় হয়।’ এ সময় রিফাতের হাতে একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন দেখা যায়।

 

সূত্রাপুরের সালেহা বুক বাইন্ডিংয়ে কাজ করছে ১১ বছরের শিশুশ্রমিক শাকিল। বাড়ি বরিশালে। আলাপকালে শাকিল জানায়, দুইবছর আগে তার মা মারা গেছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ঢাকায় কাজ নেয়। ছয় মাস হলো ঢাকায় এসেছে সে।  লেখাপড়া করতে আগ্রহী কিনা এমন প্রশ্নে শাকিল বলে, ‘কাজ না করলে খাব কি? আর লেখাপড়া করতে তো অনেক টাকা লাগে। বাবা টাকা দেবে না। সে তো উল্টো টাকা চায়।’

 

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্রে জানা যায়, সমিতির ভোটার হিসেবে পুরান ঢাকার বাবুবাজার, নয়াবাজার, সূত্রাপুর, নারিন্দা ও মাতুয়াইলে ১৮০টি প্রেস কারাখানা রয়েছে। এ ছাড়া সারাদেশে প্রায় সাত হাজার ছাপাখানা রয়েছে। সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্য জানান, শুধু পুরান ঢাকাতেই ভোটারের বাইরে প্রায় ১ হাজার প্রেস কারখানা রয়েছে। যার অধিকাংশই মানসম্মত নয়। অধিকাংশই আলো-বাতাসহীন ঘিঞ্জি পরিবেশ ও শিশুশ্রমিক নিয়োজিত।

 

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি মো. রব্বানী জব্বার বলেন, ‘আমাদের সমিতির নিবন্ধিত প্রেস কারখানাগুলোতে শিশুশ্রম নেই। এর বাইরে সারাদেশে হাজারো কারখানা রয়েছে। সেখানে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হতে পারে। এর দায়ভার সমিতির নয়। শিশুশ্রম আমাদের সমিতিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’

 

ছাপাখানাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের শিশুশ্রম নিরসনে আইনের যথাযথ প্রয়োগে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আজকের শিশুরাই আগামীতে জাতির নেতৃত্ব দেবে। শিশুশ্রম কাম্য নয়। শিশুশ্রম নিরসন এবং তাদের সুস্থ পরিবেশে আনতে দেশের আইন ও মানবাধিকার আইন রয়েছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নাই। সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *