১২০৯ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে তিন বছরে

দেশের ৪৭০টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণে ১১ বছর আগে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এর নির্মাণকাজ শুরু করে। সময় নির্ধারিত ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে।

একই সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প ব্যয়। শুরুতে এই প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয় ১৪৫ কোটি টাকা বেড়ে এক হাজার ২২৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা হয়েছে। তবু শেষ হয়নি কাজ।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

শুধু এই প্রকল্পই নয়, প্রায় সব প্রকল্পে এমন ঘটনা দেখা যায়। বেশির ভাগ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় তিন বছর। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে এক হাজার ২০৯টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে।এর মধ্যে ব্যয় বেড়েছে ১৮২টি প্রকল্পের। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪২৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। 

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় বাড়ার পেছনে প্রকল্প পরিচালকদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবই মূলত দায়ী। দেখা যায়, কোনো কোনো প্রকল্প শেষ হতে প্রায় এক দশকও লেগে যায়।ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের মহাসড়কে জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার ফোর লেনের নির্মাণকাজে তিন বছরের জায়গায় ৯ বছর লেগেছে।

র মধ্যে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে পাঁচবার, খরচ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদিত হয় জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। তখন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। সময় নির্ধারিত ছিল ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে মেয়াদ বেড়েছে। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ২১৪ কোটি টাকা।আইএমইডি ও পরিকল্পনা বিভাগের কয়েকটি প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইএমইডি ৩৫৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। ৬০টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়ানো হয় একনেক সভায়। ১৫টি প্রকল্প তিনবার মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ না হওয়ার চতুর্থবার একনেকে উঠেছে।আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩২১টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমইডি। ৫৯টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়িয়েছে একনেক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪০০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩৩৭টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে আইএমইডি। ৬৩টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়িয়েছে একনেক। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৮০টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৯৫ শতাংশ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এসব প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে শেষ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ব্যয় বাড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ৮০ শতাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ে প্রায় ৫৬ শতাংশ।নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া ও খরচ বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এবং কাজের পরিধি পরিবর্তনের বিষয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। কাজের পরিধি পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে ৪৯ শতাংশ।নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএমইডির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু প্রকল্পে সময় বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকে। অনেক দেশীয় প্রকল্প চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পায় না। তবে অনেক সময় প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে বাস্তবায়নে দেরি হয়। বেশির ভাগ প্রকল্প পরিচালকেরই প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কম। জমি অধিগ্রহণের ঝামেলা না থাকলে আর বরাদ্দ ঠিকমতো দেওয়া হলে সময় বাড়ানো ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্প দেরি হওয়ার বড় একটি কারণ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা। অনেক প্রকল্প দেখা যাচ্ছে ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই নেওয়া হয়। অর্থাৎ পুরোটাই অনুমাননির্ভর। এ কারণে প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। খরচ বেড়ে যায়। তাই প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশনা দিয়েছেন, প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ থাকলে সেগুলোয় কতটা জটিলতা আছে, সেটা চিহ্নিত করে প্রকল্প নিতে। নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার আগে এগুলো অবশ্যই দেখা হবে।’

প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালকদের কখন কোন কাজ করতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সেই পরিকল্পনা দেওয়া থাকে। কিন্তু সে অনুযায়ী তাঁরা সময়মতো কাজ করতে পারেন না। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নে এটা প্রথম বাধা।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, সেই প্রকল্প পরিচালকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও তাঁদের কারিগরি জ্ঞান খুবই সীমিত। যেহেতু আর্থিক কারণে প্রকল্পগুলো স্পেসিফিকেশন করে দেওয়া হয়েছে, সে কারণে বি এবং সি ক্যাটাগরিতে যেসব প্রকল্প আছে, সেগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে দেরি হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *