দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে ১২৫ আসনে সহিংসতার আশঙ্কা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এসব এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ এসব তথ্য জানিয়েছে।
আগাম অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, এই সংঘাতের পেছনে রয়েছে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে জয়লাভের চেষ্টা, প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে আর্থিক ও পেশিশক্তির ব্যবহার এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। নির্বাচনে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রচারণা তেমন শুরু না হলেও সংবাদমাধ্যমে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের নানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে উভয় পক্ষের সাতজন আহত হয়।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার পিরোজপুর-১ আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে লালন ফকির নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন।
শুধু এ দুই নির্বাচনী এলাকাই নয়, আরো অন্তত ৫৫ এলাকায় এই ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ১২৫টি আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৭ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। জাতীয় পার্টি, ওয়াকার্স পার্টি, জাসদের অন্তত ৩০ জন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন ভোটের মাঠে। তাঁদের অনেকে নৌকা প্রতীকও পেতে পারেন।
প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে থাকায় সহিংসতার আশঙ্কা বেড়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গত মঙ্গলবার মাসিক অপরাধ বিষয়ক সভায় এসব সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরো সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি সংঘর্ষ এড়ানোর করণীয় ঠিক করতে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সব জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দিয়েছেন।
১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৮২
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত ১১ মাসে দেশে ৮০৭টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮২ জন নিহত হয়েছে। আহত আট হাজার ১৫০ জন। এসব সংঘর্ষের বেশির ভাগ ঘটেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল এবং বিএনপির পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে।
অন্য মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ছয় হাজার ৩৩১ জন। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে সাতজন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, প্রতিপক্ষের হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আছেন অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী।
জানতে চাইলে একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ১২৫ আসনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন তাঁরা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে।
নৌকার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংঘাত বাড়ছে
গত ১৪ ডিসেম্বর পাবনা জেলা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন আহত হয়। ১৩ ডিসেম্বর বগুড়ার গাবতলীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সংঘর্ঘের ঘটনা ঘটে। এ সময় হাতবোমার বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
গত ১১ ডিসেম্বর ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শটগানের ২৫টি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। পরে বেশ কিছু দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
একই দিন ভোট চাওয়াকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২২ জন আহত হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
একই দিন বিকেলে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জিয়াউল হক মোল্লার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, যেসব আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, চাঁদপুর-১, ৪, লক্ষ্মীপুর-১ ও ৩, ফেনী-৩, নোয়াখালী-১ ও ২, কুমিল্লা-২, ৫, ৮, ৬ এবং ১১ আসন। নারায়ণগঞ্জ-১, মাদারীপুর-৩, পঞ্চগড়-১, বরিশাল-২ ও ৪, ভোলা-৩, পটুয়াখালী-৪, বরগুনা-২ ও ঝালকাঠি-১ আসনেও সহিংসতার আশঙ্কা করছে পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের একাধিক পুলিশ সুপার জানান, নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় তাঁরা বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এসব প্রার্থীকে শীর্ষ পর্যায় থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
নির্বাচনী আসনগুলোতে সহিংসতার আশঙ্কা নিয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকবে র্যাব। সহিংসতা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি যারাই লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে কে কোন দলের প্রার্থী বা নেতা, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর ৩০ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এর বাইরে ১৫২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সব ইউনিটের সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।