চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, আফসানা মিমিরা এসেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মহড়া অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মূল ভবন হল অব ফেমে সামনের দিকে বসে আছেন। হঠাৎ তাঁদের পেছনের সারিতে চোখ আটকে যায়। সেখানে জড়সড় হয়ে বসে আছে আট বছর বয়সী এক শিশু। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। গায়ে সাদামাটা পুরোনো জামা। মহড়া অনুষ্ঠানের মঞ্চে কী হচ্ছে, সেদিকে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। নাম জিজ্ঞাসা করতেই জড়সড় হয়ে তাকিয়ে থাকে। জানা গেল, তাঁর নাম ফারজিনা আক্তার। সে মা-বাবার সঙ্গে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে। ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমাটির জন্য লাজুক ফারজিনা শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে।
খুব একটা কথা বলতে চায় না ফারজিনা। পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে শুনে শুধু তাকিয়ে থাকে। কখনো ছোট করে হাসে। তাতে বোঝা যায় খুশি। কিন্তু লজ্জায় কথা বলে না। তার সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করা দরকার। কথার বলার জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মূল ভবন থেকে বাইরে নিয়ে আসি। সেখানে একপাশে টানানো অভিনয়শিল্পীদের ছবি—যাঁরা চলতি বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন। একসময় শিশুটির ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করি, এটা কার ছবি। সে নিজের ছবি দেখে হাসে। লাজুক ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার ছবি।’ পাশ থেকে তাঁর বাবা সায়েম বলেন, ‘ও তহন অনেক ছোট ছিল।’ পরক্ষণেই তিনি মেয়েকে প্রশ্ন করেন, ‘অভিনয়ের কথা তোর মনে আছে মা?’ মেয়েটা আবারও হাসে। জামার এক অংশ টেনে মুখে নিয়ে কামড়াতে থাকে। তার বাবা নিজেরই বলতে থাকেন, ‘এগুলো ওর মনে নেই। অনেক ছোট ছিল।’
চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসানদের সঙ্গে তাঁর ছবি দেখে কৌতূহলী হয়ে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ফারজিনা। তাকে প্রশ্ন করি, ‘এঁদের চেনো?’ সে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ায়। আস্তে আস্তে তাঁর লাজুক ভঙ্গির খোলস বদলে যেতে থাকে। সে এবার গ্রামের দুরন্ত শিশু হয়ে ওঠে। প্রতিটা প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেয়। জানতে চাই, ‘তুমি বড় হয়ে কী হবে।’ এবার সে বাবার মুখের দিকে তাকায়। তার বাবা বলতে থাকেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বড় হয়ে আর কী করবে স্যার। আমরা কি এত কিছু বুঝি? ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।’ কথাগুলো বলার ফাঁকেই তিনি মেয়েকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাঁটানো ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘ফারজানা, তুমি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেবে। তিনি তোমাকে পুরস্কার দেবেন। ভয় পাইয়ো না। তাঁকে সালাম দিয়ো।’ এবার তিনি আমার উদ্দেশে বলেন, ‘ছোট মানুষ তো। তাই সালাম দেওয়ার কথা শিখায়া দিছি।’
‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমাটির যখন শুটিং হয়, তখন ফারজিনার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। কীভাবে অভিনয় করতে হবে, সেগুলো বলে দিলে সেভাবেই অভিনয় করত। কিন্তু রাজি করাতে বেগ পেতে হয়েছে। শুটিংয়ে অনেক মানুষ থাকে, তাদের সামনে অভিনয় করতে লজ্জা পেত। ফারজিনাকে বলি, কাল পুরস্কার নেবে, খুশি লাগছে না! শিশুটি বলে, ‘পুরস্কার নিতেই তো ঢাকাত আইছি। আমাদের টাকাও দেবে। সেই টাকা দিয়ে বাড়ি বানাব। আমাদের কোনো বাড়ি নেই।’
পরিচালক কাইউমের সঙ্গে ফারজিনা আক্তার।
মুহূর্তের জন্য থেমে যেতে হলো। তাদের বাড়ি নেই। তাহলে কোথায় থাকে। এমন প্রশ্ন শুনে ফারজিনার বাবা বলেন, ‘আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিছি। আমাদের চাচাতো ভাইয়েরা কিনছে। এহন আমরা ওর নানিবাড়ি থাকি। এত বড় পুরস্কার পাচ্ছে। এটা নিয়ে কোথায় রাখব সেই জায়গাটা নাই। আমাকে যখন কায়াম স্যার (মুহাম্মদ কাইউম) পুরস্কারের কথা বলতে ফোন দিয়েছিলেন, তখন জানায় ছিলেন, এই পুরস্কারের সঙ্গে টাকা পাব। মেয়ে সেটা শুনেছে। এরপর থেকে বলছে, “বাবা, আমরা যে টাকা পাব, সেই টাকা দিয়ে বাড়ি করব।” আমার ইচ্ছা আছে বাড়ি করার। মেয়েটা এবার ওয়ানে পড়ে। কিন্তু বাড়িঘর না থাকায় ঠিকমতো স্কুলে যায় না। তাঁর খুব আশা নিজের বাড়িতে থাকা। এটা আমাকে খুবই কষ্ট দেয়।’ ফারজিনার বাবা কৃষিকাজ করেন।
দুই দিন আগে ফারজিনারা তাহিরপুর থেকে বাসে ঢাকায় এসেছে। বাসস্ট্যান্ডে সরকারি গাড়ি গিয়েছিল। তারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকছে। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর মা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানের পোশাক নিয়ে অনেকের অনেক রকম প্রস্তুতি থাকে। তবে ফারজিনার বাবা গ্রামের বাজার থেকে স্বল্প দামে কাপড় কিনে একটি জামা বানিয়ে দিয়েছেন। সেটা পরেই আজ পুরস্কার নিতে চায় এই শিশু।
টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় শুটিং লোকেশন দেখতে যান পরিচালক মুহাম্মদ কাইউম। সেখানে একটা বাড়ি শুটিংয়ের জন্য পছন্দ করেন। সেই বাড়িটি ফারজিনাদের। তখন ছোট এই মেয়েকে দেখে পরিচালকের শিশু চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পছন্দ হয়। শিশুটি শুরুতে রাজি না হলেও পরে সে সবাইকে চমকে দিয়ে দারুণ অভিনয় করে। মুগ্ধ হন সিনেমার পরিচালক মুহাম্মদ কাইউম। তিনি বলেন, ‘এই শিশুদের বাড়িতেই আমরা শুটিং করেছি। অভাবে সেই বাড়িটি তারা বিক্রি করেছে। তারা এখন নানাবাড়ি থাকে। পুরস্কারের টাকা দিয়ে তারা বাড়ি করবে। আমি মন থেকে চেয়েছিলাম সে পুরস্কার পাক। তাহলে কিছু টাকা পাবে। এতে হয়তো তাদের কোনো রকম একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে।’ পুরস্কার হিসেবে তিনি পদক ছাড়াও পাবেন এক লাখ টাকা। গত ৩১ অক্টোবর ঘোষিত হয়েছে ২০২২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রজ্ঞাপন থেকে জানা গেছে, এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ২৭ বিভাগে শিল্পী, কলাকুশলী, প্রতিষ্ঠান ও চলচ্চিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করা হবে। আজ ১৪ নভেম্বর বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।