যদিও ইসরায়েলের শক্তিশালী দেশগুলির সাথে শক্তিশালী জোট রয়েছে, তবুও এটি একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র রয়ে গেছে। গাজার মুসলিম জনসংখ্যার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ, বিশেষ করে হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায়, ইসরায়েলি সরকারের মধ্যে ভঙ্গুরতা এবং অস্থিরতা প্রদর্শন করে।
মনে হচ্ছে, এক ধরনের আতঙ্ক বা ফোবিয়ায় ইসরায়েল আক্রান্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে, অস্তিত্ব সংকটে পড়ার মতো কোনো অনুভূতি রাষ্ট্রটির নেতাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে
সম্প্রতি, একজন ইসরায়েলি মন্ত্রী গাজায় পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যা ইসরায়েলে একটি গভীর ভীতি বা ফোবিয়াকে তুলে ধরে। জাতির নেতারা অস্তিত্বের সংকটের অনুভূতিতে অভিভূত বলে মনে হচ্ছে।
সব দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত থাকার পরও ইসরায়েল এমন অস্থির আচরণ কেন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এটি নিয়ে বাইরের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে।
ইসরায়েল কেন গাজায় উন্মত্ত আচরণ করছে, কেন তারা গোটা গাজাকে গিলে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তার জবাব খুঁজতে গিয়ে ইসরায়েলকে জড়িয়ে ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ শব্দগুচ্ছটি আবার জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
ইংরেজিতে এই টার্মটিকে বলে ‘কার্স অব এইট্থ ডেকেড’। আরবিতে বলে ‘লা’নাতুল আকদিস সামিন’।
‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ টার্মটির জন্ম হয়েছে ইহুদিদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ন্যায়শাস্ত্র তালমুদ-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী থেকে। (এইখানে বলে রাখা ভালো, তালমুদ কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত নয়।
এটি তাওরাতের আলোকে ইহুদি পণ্ডিতদের রচিত নীতি ও আইন শাস্ত্র যা ইহুদিদের প্রাত্যহিক জীবনের করণীয়, পালনীয়, পরিত্যাজ্য বিষয়গুলোকে বাতলে দেয়)।
এই তালমুদের একটি ভবিষ্যদ্বাণী হলো: কোনো ইহুদি রাষ্ট্র আট দশকের বেশি টিকবে না। ভেঙে যাবে। আর সে ভাঙন বাইরের কোনো শক্তির কারণে হবে না। হবে নিজেদের মধ্যকার জাতি-উপজাতির কোন্দল থেকে। বাস্তবিক দেখাও গেছে তাই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গত দুই হাজার বছরে বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় সার্বভৌম ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে কিং ডেভিডের (ইসলামে যিনি নবী দাউদ আঃ) রাজত্ব আর হাসমোনিয়ান রাজত্ব ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো ‘ইহুদি রাজ্য’ ৮০ বছরের বেশি টেকেনি।
কিং ডেভিডের রাজত্ব ও হাসমোনিয়ান রাজত্ব ৮০ বছরের বেশি টিকে থাকলেও এই দুই রাজত্বের ভাঙন ধরেছিল ৮০ বছরের মাথায়। এরপর সে দুটো রাজত্ব টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ইয়ামেনের হিময়ারাইট, মেসোপটেমিয়ার নেহারদিয়া, ইথোপিয়ার সিমিনসহ অন্যান্য ইহুদি রাজ্যগুলোর কোনোটিই ৮০ বছরের বেশি টিকতে পারেনি।
আজকের আধুনিক এই ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েলের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। ২০২৮ সালে ৮০ বছর পূরণ হবে। তার মানে হাতে আছে চার বছর। তাহলে কি তালমুদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে? আর তিন-চার বছরের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি ভেঙে যাবে?
শুধুমাত্র ধর্ম কিংবা ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি এই প্রশ্ন সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে হয়তো এ নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোনো চর্চা হতো না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ কথাটি এমন সব নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে যার প্রবল রাজনৈতিক প্রভাব আছে।
যেহেতু ইসরায়েলের ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে বিশ্বাসী ও তালমুদের আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত প্রত্যাদেশের অনুসারী, সেহেতু ইসরায়েলের বাসিন্দাদের একটি বিরাট অংশ ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সিরিয়াস আলাপ আলোচনা করে থাকেন।
লেবানন থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের কোনো কোনো প্রতিবেদন বলছে, যেহেতু ইসরায়েলের বয়স এখন ৭৭ বছর, সেহেতু অনেক ইহুদি ইসরায়েলের ওপর কোনো দুর্যোগ নেমে আসলে কীভাবে সেখান থেকে সরে যাবেন, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছেন। তারা এই ন্যাচারাল ফেনোমেনন বা প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ অমোঘ নিয়মে নেমে আসতে পারে বলে বিশ্বাস করেন।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক (যিনি কিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে দেশটির সেনাপ্রধান হিসেবে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সম্মানসূচক মেডেল পেয়েছিলেন) গত বছর ইসরায়েলের ‘ইয়েদিয়ত আহরোনত’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইহুদিদের গোটা ইতিহাসে দুটি ছাড়া ৮০ বছরের বেশি স্থায়ীত্বকালের কোনো রাষ্ট্র ইহুদিদের ছিল না। সে দুটির একটি হলো, কিং ডেভিডের রাজত্ব ও হাসমোনিয়ান রাজত্ব।
উভয় রাজত্বকালের ভাঙনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল অষ্টম দশকে। অষ্টম শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে ফিকে হতে থাকা আগেকার সেই ইহুদি রাজ্যগুলোকে যে বিভাজন জর্জরিত করছিল, সেই বিভাজন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
ওই নিবন্ধে এহুদ বারাক বলেছেন, ইসরায়েল সমাজে বিভাজন ও বিভেদ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বামপন্থী বনাম ডানপন্থী; ধর্মীয় গ্রুপ বনাম সেক্যুলার গ্রুপ; ধর্মীয় জায়নবাদী বনাম ধর্মীয় ইহুদিবাদী গোটা ইসরায়েলি সমাজকে শতধা বিভক্ত করছে যা ইসরা
এহুদ বারাকের মতোই বিভক্তি নিয়ে তারও আগে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন, ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন। ২০১৭ সালে তিনি হার্জলিয়া কনফারেন্সে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ইসরায়েলে ৩৮ শতাংশ সেক্যুলার ইহুদি, ১৫ শতাংশ জায়নবাদী ইহুদি, ২৫ শতাংশ আরব এবং জায়নবাদী নয় এমন উগ্র অর্থোডক্স মৌলবাদীরা আছে ২৫ শতাংশ। রিউভেন বলেছিলেন, এরা নিজেদের মধ্যে যেভাবে বিবাদে জড়াচ্ছে তা উদ্বেগের বিষয়।
রিউভেন বলেছিলেন, ‘আমরা জায়নবাদীরা এই বাস্তবতা কি মেনে নিতে পারি? আমরা কি এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারি যে, ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (আরব ও ফান্ডামেন্টালিস্ট ইহুদি) নিজেদের জায়নবাদী মনে করে না এবং আমাদের জাতীয় সংগীত গায় না?’
২০১৭ সালে ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই অস্তিত্ব বিষয়ক হুমকির কথা মাথায় রেখে এক হয়ে থাকতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ১৪০ বছর ধরে কেনান শাসন করা হাসমোনিয়ান ইহুদিরাও ৮০ বছরের বেশি একতা ধরে রাখতে পারেনি।’
চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রিত্ব নেওয়ার আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে আট দশকের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার নিশ্চয়তা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই দিতে পারে।
আর এর আগের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২০ সালে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, একমাত্র তাঁর সরকারই অষ্টম দশকের অভিশাপকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই দেশের ভেতর থেকে ভেঙে না পড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে; কারণ ইসরায়েলের মুখোমুখি সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি। আমরা সেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছি যা ইহুদিদের পূর্ববর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে ঘটেছিল।’
অর্থাৎ এই ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ নিয়ে যে একটি ধারণা ইহুদিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, সেটি এই নেতাদের কথায় বোঝা যায়।
অবশ্য ইতিহাসবেত্তাদের অনেকে বলছেন, যেহেতু এর আগের সবগুলো ইহুদি রাজ্য ৮০ বছরের মধ্যে ভেঙে পড়েছে, সে কারণে ভবিষ্যতে যাতে ইহুদিরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে শেষ না হয়ে যায়; তাঁরা যাতে একতাবদ্ধ থাকে; সে জন্য ধর্মীয় নেতারা এই অভিশাপের কথা বলেছেন।
দ্য মিডল ইস্ট মনিটর পত্রিকায় ২০২২ সালের ১২ মে প্রকাশিত একটি কলামে লিগ অব পার্লামেন্টারিয়ানস ফর আল কুদস-এর মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মাকরাম বালাবি বলেছেন, ইসরায়েলিদের মধ্যে নানা বিভেদ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। হেরেদি সম্প্রদায় ও ধর্মীয় জায়নবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক গভীর হয়েছে।
হেরেদি সম্প্রদায় জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন, তারা তাওরাতের শিক্ষার পরিপন্থী কাজ করে থাকেন এবং তাঁদের জুলুমের কারণেই মুসলমানদের দিক থেকে ইহুদিদের ওপর পাল্টা আঘাত আসে। আর জায়নবাদীরা হেরেদি সম্প্রদায়কে আরবদের তোষণকারী বলে থাকে। এ ইস্যুতে আদর্শগতভাবে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব গভীর হচ্ছে।
‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ শুধু যে ইহুদি সমাজে আলোচিত হয় তা নয়, ফিলিস্তিনি ও আরব নেতাদের কথার মধ্যেও সেই শাস্ত্রীয় অভিশাপের উল্লেখ অনেকবার এসেছে।
২৫ বছর আগে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন বলেছিলেন, ইসরায়েলের ভেঙে পড়ার সময়কাল শুরু হয়ে গেছে।
হামাসের বর্তমান মুখপাত্র আবু উবায়দাও তাঁর সর্বশেষ ঘোষণায় ইহুদিদের উদ্দেশে বলেছেন, ইসরায়েলের সময় শেষ। এই যুদ্ধই চূড়ান্ত যুদ্ধ।
অবশ্য ইতিহাসবেত্তাদের অনেকে বলছেন, যেহেতু এর আগের সবগুলো ইহুদি রাজ্য ৮০ বছরের মধ্যে ভেঙে পড়েছে, সে কারণে ভবিষ্যতে যাতে ইহুদিরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে শেষ না হয়ে যায়; তাঁরা যাতে একতাবদ্ধ থাকে; সে জন্য ধর্মীয় নেতারা এই অভিশাপের কথা বলেছেন।
অনেকে বলছেন, ৮০ বছরে তৃতীয় প্রজন্মের উদ্ভব হয়। তাঁরা বলছেন, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রজন্ম সাধারণত ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাঁদের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা বিরোধ তৈরি হয়।
আর দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে সেই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এতে মোটামুটি ৮০ বছর সময় লেগে যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইসরায়েলের নাগরিকদের পারস্পরিক মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েল নামক শক্তিশালী রাষ্ট্রটি অন্তর্কোন্দলে ভেঙে যাবে তা কোনো যুক্তির কথা নয়।
তাঁরা এই অভিশাপের ধারণাটিকে ধর্মীয় কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চান।
কিন্তু যেহেতু ইসরায়েলের জনগণের মনে এ নিয়ে একটা আতঙ্ক রয়ে গেছে, সেহেতু হামাসের সর্বশেষ এই হামলাকে তাঁদের অনেকে ‘অষ্টম দশকের অভিশাপের’ সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন।
এতে তাঁরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন এবং সে কারণেই হয়তো ইসরায়েল সরকার সাধারণ জনমানসকে আশ্বস্ত করতে দানবের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।