৫ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি পিপিপির নির্দেশনা

দেশের অর্থনীতি একটি সংকটময় পরিস্থিতি পার করছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট, সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার সংকটসহ বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়াতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

 

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে থাকা মোট প্রকল্পের ৩০ শতাংশ সিদ্ধান্ত থাকলেও পাঁচ বছরে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। দেশের সংকটময় অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এ মডেল আবার ফিরিয়ে আনতে চায় পিপিপি কর্তৃপক্ষ।

 

২০১৮ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এডিপির অধীনে থাকা মোট প্রকল্পের ৩০ শতাংশই থাকবে পিপিপির অধীনে। কিন্তু পিপিপির প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা, প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে আরো বেশি ব্যয়, আমলাদের আগ্রহ কম থাকা, বিনিয়োগে টানতে না পারা, এ ধরনের প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের ভার জনগণের কাঁধে ঠেলে দেওয়াসহ নানা কারণে পিপিপি মডেল কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থ পিপিপি মডেলকেই আবার ফেরাতে চায় সরকার। 

সম্প্রতি পিএমএফ অফিসের পরিচালক আলী আজম আল আজাদ স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে পিপিপি কর্তৃপক্ষের বোর্ড অব গভর্নরসের দ্বিতীয় সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন, নতুন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের খসড়া হ্যান্ডবুকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পিপিপিতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আগ্রহ কম। ফলে এডিপিতে ৩০ শতাংশ প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয়গুলো সরকারের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

 

টাকা পেতে ঝামেলা নেই। পরিশোধেরও ঝামেলা নেই।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি বেশির ভাগ কর্মকর্তা পিপিপিতে প্রকল্প নিতে চান না, কারণ তাঁদের ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। সরকারি প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকরা যেভাবে নিজেদের মতো করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, পিপিপি প্রকল্পে তাঁরা সে ক্ষমতা পান না। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়।২০১৮ সালের ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পিপিপি কর্তৃপক্ষের বোর্ডের দ্বিতীয় কার্যনির্বাহী সভায় প্রকল্পে পিপিপি গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩০ শতাংশ প্রকল্প পিপিপিতে নেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। যেসব প্রকল্পের ব্যয় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে ফেরত পাওয়া সম্ভব সেসব প্রকল্প পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নিতে হবে।

 

নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে পিপিপি পদ্ধতিতে করা সম্ভব কি না, তা প্রথমে বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে ‘লিংকড প্রকল্প’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

পিপিপি মডেলকে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে আলী আজম আল আজাদ বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য পিপিপি একটি নতুন ধারণা। এটি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সে পরিবেশ এখন নেই। মেগাপ্রকল্পে বিনিয়োগ করার জন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কি প্রস্তুত? এখানে আমাদের এখন সে ধরনের পরিবেশ ও মাঠ তৈরি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আস্থা তৈরী করতে হবে, এখানে পিপিপি বিনিয়োগ সম্ভব। তখন তারা আসবে। এ সময়টা আমাদের সহ্য করতে হবে। এটা যদি করা যায় এর সাফল্য প্রথাগত সরকারি প্রকল্পগুলো থেকে অনেক বেশি।’

 

তাঁর মতে, দেশে পিপিপি মডেল বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে। এ মডেল হলে বিনিয়োগ ও বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ঝুঁকিও নেবে তারা। বেশির ভাগই তারা নিয়ন্ত্রণ করবে। সরকার শুধু তাদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে সেবা পাবে। আগে ডেলিভারি পরে পেমেন্ট।

 

গত এক যুগে পিপিপি মডেলের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও পিপিপির অধীনে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, ঢাকা বাইপাস প্রকল্প, গাবতলী-সাভার-নবীনগর এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স, ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চুক্তি হয়েছে ২০১১ সালে। তখন পরিকল্পনা ছিল এটি হবে মূল রাস্তার ওপরে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত হয় মূল রাস্তার ওপর করা হলে মানুষের ভোগান্তি হবে কয়েক গুণ বেশি। এ জন্য পরে সিদ্ধান্ত হয় রেলের ওপর দিয়ে করা হবে। এটি করতে গিয়ে সরকারের ১৪টি সংস্থার ভূমি নিতে হয়েছে। এত সংস্থার কাছ থেকে আলোচনা করে ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে অনেক সময় লেগে গেছে। সব অধিগ্রহণ শেষে কাজ শুরুই হয়েছে ২০২০ সালে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *