বরিশালে হরতাল-অবরোধ ঘিরে আটক বিএনপির অন্তত ১১৪ নেতা-কর্মী ও তাঁদের স্বজনদের মেট্রোপলিটন আইনের ৮১ ধারায় আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিদিনই দু-একজন করে ৮১ ধারায় গ্রেপ্তার আসামিকে বিভিন্ন থানা থেকে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। এই ধারার এমন প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনের ৮১ ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি শান্তিভঙ্গের উসকানিদানের উদ্দেশ্যে কোনো রাস্তায় বা সর্বসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে ভীতিমূলক গালাগাল বা অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করলে এবং এর দ্বারা শান্তিভঙ্গের কারণ সৃষ্টি করলে তিনি ৫০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে পুলিশের হাতে আটক বিএনপির নেতা-কর্মীদের মেট্রোপলিটন আইনের ৮১ ধারায় চালান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদিও পুলিশ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নগরবাসীর সুরক্ষার কাজে ব্যবহৃত ধারাটির ‘অপব্যবহারের’ বিষয়টিকে ‘অনভিপ্রেত’ বলছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, দলের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করতে সরকারের পক্ষে পুলিশ এমন কৌশল নিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, যাঁদের অপরাধ লঘু তাঁদের ৮১ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়। এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্র জানায়, চলতি মাসে নগরের চারটি থানায় গত সোমবার পর্যন্ত ১১৪ জনকে ৮১ ধারায় আদালতে পাঠায় পুলিশ। তাঁদের কেউ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতা কিংবা তাঁদের আত্মীয়স্বজন। এর মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানা থেকে সর্বোচ্চ ৬৯ জনকে আদালতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কাউনিয়া থানায় ১৮ জন, বন্দর থানায় ১৯ জন ও বিমানবন্দর থানায় ৮ জন আছেন।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটিকে ভিন্নভাবে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে অনেককে আটক করে পুলিশ। তাঁদের সবার একই ধরনের অপরাধ থাকে না। অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও থাকেন। ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য মাধ্যমে যাচাই করে যাঁরা নিরপরাধ, তাঁদের থানা থেকেই ছেড়ে দেওয়া হয় এবং যাঁদের অপরাধ লঘু বলে প্রতীয়মান হয়, তাঁদের ৮১ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়।
তবে আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্রতিদিনই দু-একজন করে ৮১ ধারায় গ্রেপ্তার আসামিকে বিভিন্ন থানা থেকে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে এমনটি ছিল না।
পুলিশ, বিএনপি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর রাতে পুলিশের হাতে আটক হন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবু মুছা। পরদিন সকালে আটক হন ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুস সোবহান, ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজীব মোল্লা, মহানগর যুবদলের সহসভাপতি জাহিদ হোসেন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের আহ্বায়ক উজ্জ্বল বাড়ৈ, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতায়ে রাব্বি। তাঁদের সবাইকে ৮১ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ আদালতে পাঠানোর পর তাঁরা মুক্তি পান। একইভাবে ১ নভেম্বর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান নেতা-কর্মীদের নিয়ে অবরোধের পক্ষে মিছিল করার চেষ্টা করলে নবগ্রাম থেকে আটক হন। তাঁর সঙ্গে আটক হন তাঁর ভাতিজা অ্যাঞ্জেল খান। একই দিন দুপুরে নগরের নাজিরেরপুল এলাকা থেকে আটক হন মনিরুজ্জামান খানের ছেলে শোয়েবুজ্জামান খান। পরে শোয়েবুজ্জামানকে কোতোয়ালি মডেল থানায় দেখতে গিয়ে আটক হন শোয়েবুজ্জামানের ছেলে শফিউজ্জামান খান। মনিরুজ্জামান খান ছাড়া তাঁর পরিবারের ৩ সদস্যকেই ওই দিন ৮১ ধারায় আদালতে সোপর্দ করা হলে তাঁরাও মুক্তি পান।
গত রোববার সন্ধ্যায় এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেককে আটকের পর পুলিশ টাকা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘টাকা নিয়ে কাউকে ছাড়ছেন, আবার কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েও মুক্তি দিচ্ছেন না। এমন একটা পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি।’
বরিশালে বিএনপির পদধারী নেতা ও তাঁদের স্বজনদের এভাবে মুক্তি পাওয়ার ঘটনাকে নিন্দনীয় বলে দাবি করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আফরোজা খানম। তিনি বলেন, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে বিএনপির নীতি-আদর্শ ধারণ করেন, তাঁরা কখনো টাকা দিয়ে এভাবে মুক্তির আশা করেন না, মুক্তি কামনাও করেন না। চলমান আন্দোলনে এটা সরকারের ফাঁদও হতে পারে। বিএনপির ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে আন্দোলনকে স্তিমিত করতে এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বিষয়টিকে অনভিপ্রেত উল্লেখ করে বলেন, ৮১ ধারাটি নগরবাসীর নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য। সেখানে ধারাটি পুলিশ অনৈতিক কাজে ব্যবহার করলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের নজর দেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ৮১ ধারা খুব বেশি প্রয়োগ করি না। তবে এই মুহূর্তে কিছুটা প্রয়োগ হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, জননিরাপত্তা বিঘ্ন করার কোনো অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাঁদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাঁদের অপরাধ লঘু তাঁদের ৮১ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়। এ নিয়ে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাইনি, পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’