ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে শামদেশ বলতে বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে বোঝানো হতো। অনেক নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে এই অঞ্চলে। কিয়ামতের আগে ঈসা (আ.) এ অঞ্চলে আসমান থেকে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জাল সেখানেই নিহত হবে। এখানেই হবে কিয়ামতের ময়দান।

কিয়ামতের দিন পৃথিবীর সব মানুষ সেখানে সমবেত হবে। শামদেশ এবং বিশেষ করে বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী আছে।সত্যবাদী দলের অবস্থান : উম্মতের মধ্যে একদল বিশেষ শ্রেণির লোক থাকবে, যারা সত্যের পথে লড়াই করতে থাকবে। তাদের সঙ্গে আল্লাহর সাহায্য থাকবে।

তারা সত্যের পক্ষের সংগ্রামকে কিয়ামত না আসা পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে। কেউ তাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারবে না। হাদিসের ভাষ্যমতে, এ দলটি শামদেশ অঞ্চলের অবস্থানকারী হবে। মুগিরা ইবন শোবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের এক দল সব সময় (সত্যের ওপর) বিজয়ী থাকবে।
এভাবে কিয়ামত এসে যাবে আর তারা বিজয়ীই থাকবে। (বুখারি, হাদিস : ৭৩১১)তাদের অবস্থানস্থল আরেক হাদিসে পাওয়া যায়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধীপক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না।

আল্লাহর আদেশ তথা কিয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় থাকবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,  তারা বায়তুল মাকদিস ও তার আশপাশে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ: ২২৩২০)ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও হাশরের ময়দান : মসজিদুল আকসা সব সাহাবির হৃদয়ে উপস্থিত ছিল। নারী সাহাবিদের মনেও এর প্রতি ছিল ভালোবাসা ও অনুরাগ। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই মসজিদুল আকসায় যেতে ও নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করেছেন। তবে এমন সময় আসবে, যখন মানুষ মসজিদুল আকসায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে না। তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। তা হলো-বায়তুল মুকাদ্দাস ও সেখানে অবস্থানকারীদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। মসজিদুল আকসা আলোকিত করতে অবদান রাখা। অনেক সাহাবি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেরুজালেমে বাতি জ্বালাতে তেল কেনার জন্য প্রতিবছর অর্থ পাঠাতেন। মায়মুনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বলেন, বায়তুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা তাতে গিয়ে নামাজ আদায় করো। কেননা, তাতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অন্য মসজিদে এক হাজার ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের মতো । তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সেখানে যাওয়ার শক্তি-সামর্থ্য রাখে না তার ব্যাপারে আপনার কী অভিমত? তিনি বলেন, সে যেন তার জন্য জ্বালানি তেল হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে। কেননা যে বায়তুল মাকদিসের জন্য হাদিয়া প্রেরণ করে, সে তাতে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস, ২৭৬২৬)

ঈসা (আ.) এর অবতরণস্থল ও দাজ্জালের মৃত্যুস্থান : ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.) দ্বিতীয় আকাশে অবস্থান করছেন। কিয়ামতের আগে তিনি আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার ডানায় ভর করে সিরিয়ার দামেস্ক শহরে শুভ্র মিনারার কাছে নেমে আসবেন। আবার সিরিয়ার বাবে লুদ নামক স্থানে দাজ্জালকে মেরে ফেলবেন। নাওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার দাজ্জাল প্রসঙ্গে দীর্ঘ ও বিশদ আলোচনা করেছেন।…এক পর্যায়ে তিনি বলেন, তখন আল্লাহ ঈসা ইবন মারইয়ামকে প্রেরণ করবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার কাঁধের ওপর ভর করে ওয়ারস ও জাফরান রংয়ের জোড়া কাপড় পরিহিত অবস্থায় দামেস্ক নগরীর পূর্ব দিকের উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন। যখন তিনি তাঁর মাথা ঝুঁকাবেন তখন ফোঁটা ফোঁটা ঘাম তাঁর শরীর থেকে গড়িয়ে পড়বে। তিনি যেকোনো কাফিরের কাছে যাবেন সে তাঁর শ্বাসের বাতাসে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁর দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যাবে তাঁর শ্বাসও ততদূর পর্যন্ত পৌঁছবে। তিনি দাজ্জালকে সন্ধান করতে থাকবেন। অবশেষে তাকে (সিরিয়ার) বাবে লুদ নামক স্থানে গিয়ে পাকড়াও করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭)

মুসলিমদের দ্বিতীয় হিজরত ভূমি : ইসলামে হিজরত বলতে সাধারণত রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদের মক্কা থেকে মদিনার হিজরতকে বোঝায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শামের লোকজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হবে এবং তাদের দিকে আরেকটি হিজরত হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগির সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবে তারাই, যারা ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতভূমিতে (শামদেশে) অবস্থান করবে। আর গোটা পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষ বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফিতনার আগুন বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে, সেখানেই ফিতনা লেগে থাকবে)। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮২)

মুসলমানদের সেনাছাউনি : একসময় মুসলমানদের অাশ্রয়স্থল হবে। দামেস্ক নগরী আর তাদের সেনাছাউনি হবে। তার পার্শ্ববর্তী গোতা নগরী। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে গোতা শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উৎকৃষ্ট শহরগুলোর একটি।
(আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৯৮)

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করতে পারবে, যখন তোমাদের সেখানে বসবাসের এখতিয়ার দেওয়া হবে, তোমরা দামেস্ক নগরীকে বাসস্থান বানাবে, কেননা তা যুদ্ধবর্তীকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে, আর তাদের ছাউনি হবে সে দেশের একটি ভূমি, যাকে গোতা বলা হয়।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৭০)

এসব ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করে যে কিয়ামত যত ঘনিয়ে আসবে, ফিলিস্তিন অঞ্চল ততই আলোচিত ও অপরিহার্য অঞ্চলে পরিণত হবে। ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি সে দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হয়। আল্লাহ তাআলা শামদেশ তথা নির্যাতিত জনপদ সিরিয়া, ফিলিস্তিনসহ সব মুসলিম অঞ্চলকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *